করোনাভাইরাস একপর্যায়ে বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৭০০ কোটি ৮০ লাখ মানুষের ক্রীড়াঙ্গন নীরব করে দিয়েছিল। মানবজাতির ইতিহাসে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গনে এ ধরনের নজির আর নেই। আইওসি (আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি) বাধ্য হয়েছে জাপানে ‘টোকিও অলিম্পিক-২০২০’ চলতি বছর থেকে ‘শিফট’ করে আগামী বছর জুলাই মাসে নিয়ে যেতে। আধুনিক বিশ্বে অলিম্পিক ‘গ্রেটেস্ট স্পোর্টস শো অন দ্য আর্থ’-এর আগে কখনো সংক্রমিত প্রাণ হরণকারী মহামারির জন্য বাধাগ্রস্ত হয়নি। এবার আমাদের সেই অভিজ্ঞতা হলো। জীবনের চেয়ে তো খেলাধুলা বড় নয়। ভয়, আতঙ্ক আর ভয়ানক অনিশ্চয়তার মধ্যে তো জীবনের জয়গানের বাঁশি বাজানো যায় না। ক্রীড়াঙ্গন তো সাম্য, সহমর্মিতা, ভালোবাসা, মানবতা, একে অপরকে কাছে টানা, বোঝা এবং জাগ্রত বিবেকের নিকেতন।
বাংলাদেশে সরকারিভাবে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে গত ৮ মার্চ। এরপর এই সংক্রমিত মহামারি দ্রুত দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ভীষণ শক্তিশালী মহামারি। পরীক্ষার মাধ্যমে শনাক্ত রোগী তো আছে, সমস্যা হলে উপসর্গহীন সংক্রমিত ব্যক্তিদের সংস্পর্শে সুস্থ মানুষও সংক্রমিত হতে পারেন। সব সময় ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি। এর পরও জীবন চলবে। জীবন চালাতে হবে।
ঢাকার মিরপুর স্টেডিয়ামে দর্শকদের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ ও জিম্বাবুয়ের মধ্যে শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১৩ মার্চ। এরপর আর কোথায়ও আন্তর্জাতিক ক্রিকেট অনুষ্ঠিত হয়নি। এর আগে ১১ মার্চ সিডনিতে ওয়ানডে ইন্টারন্যাশনাল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছে অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে। খেলায় অস্ট্রেলিয়া জিতেছে ৭১ রানে।
বাংলাদেশ সরকার ‘সাধারণ ছুটি’ ঘোষণা করেছে ২৬ মার্চ। শেষ পর্যন্ত এই সাধারণ ছুটি শেষ হয়েছে ৩০ মে ২০২০। করোনার এই আকস্মিক দুর্যোগের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা, দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং দূরদর্শিতার মাধ্যমে যেভাবে রাত-দিন কাজ করেছেন, জাতির মনোবলকে চাঙ্গা রাখতে সক্ষম হয়েছেন, বারবার মানুষকে বলেছেন ভেঙে না পড়তে, বিশ্বাস না হারাতে—এটি অনন্য এবং অসাধারণ। জাতির অভিভাবক হিসেবে সরকারপ্রধান একাই কিছু পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা নিয়ে লড়েছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, মধ্যপ্রাচ্য এবং এশিয়ার বিভিন্ন দেশ যখন বিপর্যস্ত—প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘লকডাউন’ দিয়ে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক রাখার পরামর্শ দিয়েছেন বারবার। যতটা সম্ভব স্বাস্থ্যবিধি মেনে, সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড সচল রাখার ব্যবস্থা করেছেন। প্রয়োজনীয় প্রণোদনা দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এর ফলে অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। বাংলাদেশের অর্থনীতি অল্প সময়ের মধ্যে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের অর্থনীতি ভালো আছে। অর্থনীতি এখনো বাড়ছে। মানুষ আশ্বাস ও বিশ্বাস ফিরে পেয়েছে। দেশের অর্থনীতির দিকে তাকালে দেখব করোনা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপ্রত্যাশিত সুযোগও এনে দিয়েছে। আবার দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের জনস্বার্থ ব্যবস্থার দুর্বলতা। এই মহামারি কবে নিয়ন্ত্রণে আসবে কিংবা নির্মূল হয়ে যাবে, এমন কথা কেউ বলতে পারবেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে রোগ মোকাবেলায় সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণটাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে শিথিলতা মারাত্মক হতে বাধ্য। স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে, আছে এমন কোনো কিছু ক্রীড়াঙ্গন ছাড়াও সমাজের কোনো ক্ষেত্রে এখন আর উৎসাহিত হওয়া উচিত নয়, করোনা কাউকে ছাড় দেয় না। সমাজজীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রের মতো ক্রীড়াঙ্গনেও আমরা কী দেখেছি এবং এখনো কী দেখছি। নিজকে, নিজের পরিবারকে এবং সমাজের সবাইকে এই বিপদ থেকে দূরে রাখার দায়িত্ব এখন সবার।
সরকারের নির্দেশে দেশে গত ৭ মার্চ থেকে খেলার চর্চা বন্ধ হয়। ক্রীড়াঙ্গনে নেমে আসে নীরবতা। খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদরা কিছুদিনের মধ্যেই হাঁপিয়ে ওঠেন; কিন্তু কিছুই করার নেই। তাঁদের ফিটনেস এবং ফর্ম ধরে রাখা একটা চলমান প্রক্রিয়া। কয়েক মাস ক্রীড়াচত্বরের বাইরে থাকায় যে ক্ষতি হয়েছে, এই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে যথেষ্ট সময় লাগবে। গত ১০ আগস্ট ১০টি শর্তে সীমিত আকারে খেলাধুলার আয়োজন ও প্রশিক্ষণ শিবির পর্যায়ক্রমে শুরু করার অনুমতি দেয় যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়। ধীরে ধীরে জেগে উঠছে ক্রীড়াঙ্গন। এরই মধ্যে ফিল্ড স্পোর্টস এবং ইনডোর স্পোর্টসের অনেক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আমাদের ফুটবল মাঠে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বেশ আগেই দর্শকের উপস্থিতি উৎসাহিত করা হলেও ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার লিগে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে সীমিত দর্শক ও ক্লাব সমর্থকদের খেলা দেখার সুযোগ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন শর্ত আরোপ করে। গত মার্চের পর ইংল্যান্ডে দর্শক আবার সুযোগ পাচ্ছেন খেলা দেখার। মুখে মাস্ক বাধ্যতামূলক। গ্যালারিতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে উল্লাস করা যাবে। তবে কাউকে আলিঙ্গন করা যাবে না। জোরে চিৎকার ও গান গাওয়া যাবে না। যাবে না হাই ফাইভ করাও। কথাগুলো এ জন্যই লিখলাম, চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে তো ফেডারেশন কাপের মাধ্যমে আমাদের ফুটবল মৌসুম শুরু হওয়ার কথা আছে। স্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে কোনো রকম খেলাধুলা চালানো পুরোপুরি নীতিবিবর্জিত কাজ। এইতো দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের ওয়ানডে চলতি সিরিজ দুই দেশের ক্রিকেট বোর্ড বাতিল করেছে। কারণ হলো দুই দলের কয়েকজন ক্রিকেটার ও দুই হোটেল কর্মীর করোনা ‘পজিটিভ’ পাওয়া গেছে।
বর্তমানে ঢাকার মিরপুর ক্রিকেট স্টেডিয়ামে বঙ্গবন্ধু টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট চলছে দর্শকবিহীন মাঠে জৈব সুরক্ষাবলয়ের আওতায়। এর আগে বিসিবি তিন দলকে নিয়ে প্রেসিডেন্ট কাপের আয়োজন করেছিল স্বাস্থ্যবিধি পুরোপুরি মেনে। আগামী জানুয়ারিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বাংলাদেশ সফরে আসার কথা আছে। এরই মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে দুজন প্রতিনিধি এসে নিরাপত্তা এবং জৈব সুরক্ষাবলয় ও স্বাস্থ্য প্রটোকল সম্পর্কে অবহিত হয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। এখন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড সিদ্ধান্ত নেবে। জানি, ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষে সেটি সম্ভব, অন্যান্য খেলার ফেডারেশনের পক্ষে সেটি সম্ভব নয়। তাদের সেই আর্থিক সামর্থ্য নেই। জৈব সুরক্ষাবলয় নিশ্চিত করা সম্ভব নয়, তবে তা ভাবাও হচ্ছে না। আমাদের বক্তব্য হলো, অন্যান্য খেলার ফেডারেশনগুলোকে যত দূর সম্ভব চেষ্টা করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। করোনা পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ না হলে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। পরীক্ষায় পজিটিভ হলে তো ক্রীড়াচত্বরের অনেক দূরে! ‘নো মাস্ক নো এন্ট্রি’ লিখলেই সব দায়িত্ব পালন হয়ে যায় না। এটা কখনো মেনে নেওয়া যায় না, করোনা পরীক্ষা করতে বললে ২০০ টাকার জন্য এন্ট্রি কমে যাবে! কম্পিটিশনের আয়োজন করতে হলে করোনা পরীক্ষার ফি নিজ নিজ খেলার ফেডারেশনকেই বহন করতে হবে। সামর্থ্য না থাকলে প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হবে না। যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয় এটা কোনো বাধ্যতামূলক করেনি। এই ক্ষেত্রে ফেডারেশনগুলোর মধ্যে তো কোনো রকম প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়ারও কথা নয়। প্রতিযোগিতা আয়োজন করতে হলে ফেডারেশনকে সব দায়দায়িত্ব নিয়ে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে আয়োজন করতে হবে। দল এবং খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের ওপর ছেড়ে দিলে চলবে না। বুঝতে হবে, দেশে করোনা শনাক্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। হাসপাতালগুলোতে ভিড় বাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী বারবার দেশবাসীকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছেন।
ইকরামউজ্জমান : কলামিস্ট ও বিশ্লেষক