এ বিশ্ব সফলদের মনে রাখে। দ্বিতীয় যে হয়, তাঁকেও নাকি ভুলে যায় সবাই। বহুদিন চলে চালু থাকা এ ‘অলিখিত’ তত্ত্বটাকে গতকাল রোববার ভুল প্রমাণ করেছেন ভুটানের অ্যাথলেট কিনজ্যাং লামো। প্যারিস অলিম্পিকের শেষ দিনে নতুন এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন ২৬ বছর বয়সী এ নারী দৌড়বিদ।
গতকাল নারীদের ম্যারাথনে অংশ নিয়েছিলেন লামো। ২৬.২ মাইলের এ প্রতিযোগিতায় ৯১ জন প্রতিযোগী অংশ নিয়ে ৮০ জন সীমারেখা স্পর্শ করতে পেরেছেন। ভুটানের প্রতিনিধি লামো দৌড় শেষ করেছেন সবার পেছনে থেকে, অর্থাৎ ৮০তম হয়েছেন তিনি। এরপরেও সবাইকে ছাপিয়ে আলোচনার শীর্ষে লামো।
সবার আগে দৌড় শেষ করা নেদারল্যান্ডসের সিফান হাসানের (২ ঘণ্টা ২২ মিনিট ৫৫ সেকেন্ড) চেয়ে ৯০ মিনিটেরও বেশি নিয়েছেন লামো (৩ ঘণ্টা ৫২ মিনিট ৫৯ সেকেন্ড)। এমনকি ৭৯তম যে হয়েছেন, নেপালের শান্তষি শ্রেষ্ঠার (২ ঘণ্টা ২২ মিনিট ০৬ সেকেন্ড) চেয়েও প্রায় এক ঘণ্টা বেশি সময় লেগেছে লামোর। এরপরেও সম্ভবত এ ইভেন্টে অংশ নেওয়া প্রতিযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হচ্ছে ভুটানি এ দৌড়বিদকে নিয়েই।
শেষ এক ঘণ্টা একা দৌড়ে হাল না ছাড়ার যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন লামো, তাতে প্যারিসে দর্শকদের ভালোবাসাতেও সিক্ত হয়েছেন তিনি। এমনকি শেষদিকে দর্শকেরাও লামোর সঙ্গে দৌড় শুরু করেন। অনেক দর্শক তো তাঁকে সঙ্গ দিয়ে শেষ কয়েক কিলোমিটার সাইকেল চালিয়েও যান। দর্শকসারি থেকে তার নামে স্লোগান ওঠে। রেস শেষ করা মাত্রই দর্শকেরা করতালির মাধ্যমে তাঁকে অভিবাদন জানান।
অথচ গতকাল এ ইভেন্টের আলোচনাটা হতে পারত প্রতিযোগীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা নিয়ে। সিফান হাসান অলিম্পিক রেকর্ড গড়ে সোনা জিতলেও খুব বেশি পিছিয়ে ছিলেন না বাকিরা। ইথিওপিয়ার টিস্ট অ্যাসেফা প্রথম হওয়া সিফানের চেয়ে মাত্র ৩ সেকেন্ড বেশি সময় নিয়ে দৌড় শেষ করেছেন ২ ঘণ্টা ২২ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডে। ব্রোঞ্জ জেতা কেনিয়ার দৌড়বিদ হেলেন ওবিরির টাইমিং ২ ঘণ্টা ২৩ মিনিট ১০ সেকেন্ড, অর্থাৎ সিফানের চেয়ে মাত্র ১৫ সেকেন্ড বেশি সময় নিয়েছেন তিনি। চতুর্থ যে হয়েছেন, তিনিও মাত্র ১৯ সেকেন্ড বেশি সময় নিয়েছেন সিফানের চেয়ে।
এমন জমজমাট প্রতিযোগিতার দিনে লাইমলাইট পুরোটাই কেড়ে নিয়েছেন লামো। ৭৯জন দৌড় শেষ করার পর কে বা ভেবেছিলেন, এক ঘণ্টা পর কেউ একজন আসবেন? আদতে লামো একা ছিলেন না। তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিলেন ভুটানবাসী। তাদের বিশ্বাস যেমন লামোর সঙ্গে ছিল, তেমনি সঙ্গে ছিল দর্শকসারির অবিশ্বাস্য সমর্থন।
প্যারিস অলিম্পিকের আগে ডয়েচে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লামো বলেছিলেন, ‘এমন একটা মঞ্চে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারা, এটা সবসময়ই আমার কাছে স্বপ্ন ছিল। আমার প্রথম লক্ষ্য থাকবে, ম্যারাথন শেষ করা এবং ব্যক্তিগত রেকর্ড ভেঙে দেওয়া।’
সবার পেছনে থেকে ম্যারাথন শেষ করতে পারলেও ব্যক্তিগত সেরা টাইমিং করতে পারেননি লামো। ভুটান ম্যারাথনে সর্বশেষ দুই বছরের চ্যাম্পিয়ন লামো এ বছরের মার্চে ৩ ঘণ্টা ২৬ মিনিট সময় নিয়েছিলেন। এর আগে ২০২২ সালে হিমালয় পর্বতমালার মধ্য দিয়ে ১২৬ মাইল (২০৩ কিলোমিটার) দৌড়ে দ্বিতীয় হয়েছিলেন তিনি। মূলত আর্মিতে যোগ দেওয়ার পর থেকেই এমন দৌড়ের নেশা শুরু হয় লামোর।
সেই নেশা থেকেই প্রথমবার বিশ্বমঞ্চে খেলতে নেমে হইচই তুলে দিলেন। লামোর গতকালের কীর্তি ১৯৬৮ অলিম্পিকে তানজানিয়ার জন স্টেফান আখওয়ারির স্মৃতি মনে করিয়ে দিয়েছে। সেবার মাঝপথে চোটে পড়েও ম্যারাথনের শেষ লাইন স্পর্শ করেছিলেন স্টেফান।
তাঁকে সেসময় প্রশ্ন করা হয়েছিল, কেন চোটে পড়েও দৌড়েছিলেন। জবাবে স্টেফান যা বলেছিলেন, সেটা ইতিহাস হয়ে আছে। স্টেফানের ভাষ্য ছিল, ‘আমার দেশ কেবল দৌড় শুরু করার জন্য আমাকে ৫০০০ মাইল দূরে পাঠায়নি। তারা আমাকে দৌড় শেষ করার জন্য পাঠিয়েছে।’
লামোও গতকাল এমনটা ভেবে দৌড়েছিলেন কিনা, কে জানে!
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, Bangladesherkhela.com এর দায়ভার নেবে না।