বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার দ্বৈরথ এখন আর কেবলই ক্রিকেট ম্যাচ নয়, বরং সময়ের সঙ্গে গড়ে ওঠা এক রুদ্ধশ্বাস রাইভালরি। ইতিহাস-ঐতিহ্যে লঙ্কানরা অনেক এগিয়ে থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে টাইগারদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই লড়াইয়ে এনেছে নতুন রঙ।
দীর্ঘ সময় ধরে শ্রীলঙ্কার আধিপত্য থাকলেও, গত এক দশকে বাংলাদেশ উন্নতির স্পষ্ট ছাপ রেখে দিয়েছে। বিশেষ করে ঘরের মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক পারফরম্যান্স তুলে ধরেছে টাইগাররা।
১৯৮৬ সালে শুরু হওয়া এই লড়াই দীর্ঘদিন ছিল একপেশে। তবে ২০১৮ সালের নিদাহাস ট্রফি ছিল টার্নিং পয়েন্ট। ম্যাচের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ে মাঠের বাইরে- যেখানে সাকিব আল হাসানের ‘ওয়াক আউট’ ইশারা ও শেষ মুহূর্তের উত্তেজনা বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে পৌঁছে দেয় ভিন্ন মাত্রায়।
এরপর ‘নাগিন ড্যান্স’ হয়ে ওঠে দু’দলের লড়াইয়ের প্রতীক। দানুশকা গুনাথিলকা, লাহিরু কুমারা, মুশফিকুর রহিম, লিটন দাস প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়েছেন সেই উত্তেজনায়।
২০২৩ ওয়ানডে বিশ্বকাপে দু’দলের দ্বন্দ্বে যুক্ত হয় নতুন অধ্যায়। শ্রীলঙ্কার অ্যাঞ্জেলো ম্যাথুসকে টাইমড আউট করে তাক লাগিয়ে দেন সাকিব আল হাসান। ওই সিদ্ধান্ত নিয়ে উত্তপ্ত হয় ক্রিকেট দুনিয়া। এরপর বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত এক সিরিজে শরিফুল ইসলামের মিমিক্রিত ‘ঘড়ি দেখানো’ উদযাপন ছিল শ্রীলঙ্কার পুরনো ক্ষতে লবণের ছিটা দেয়ার মতোই।
২০২২ এশিয়া কাপের আগে শ্রীলঙ্কান অধিনায়ক দাসুন শানাকার মন্তব্য, ‘সাকিব-মুস্তাফিজ ছাড়া বাংলাদেশের ভালো বোলার নেই’ দু’দলের বৈরিতাকে আরও উসকে দেয়। সেই মন্তব্যে প্রতিক্রিয়া জানান বাংলাদেশের সাবেক অধিনায়ক খালেদ মাহমুদ, পাল্টা দেন মাহেলা জয়াবর্ধনেও।
এতকিছুর পর আগামীকাল বুধবার (২ জুলাই) মাঠে গড়াতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কার মধ্যকার তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজের প্রথম ম্যাচ। কলম্বোর আর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে দিবারাত্রির এই লড়াই শুরু হবে বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টায়। মাঠের লড়াই শুরুর আগে চোখ রাখা যাক দু’দলের পরিসংখ্যানে।
দ্বিপক্ষীয় সিরিজে এগিয়ে শ্রীলঙ্কা
দু’দল এখন পর্যন্ত ১০টি দ্বিপক্ষীয় সিরিজ খেলেছে। ২০০২ সালে প্রথম সিরিজ খেলে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। সর্বশেষ সিরিজ হয়েছিল ২০২৪ সালে। শ্রীলঙ্কা জিতেছে ৬টি, বাংলাদেশ ২টি। বাকি ২টি সিরিজ ড্র হয়েছে।
মোট ম্যাচের হিসাবও লঙ্কানদের পক্ষে
মোট ৫৭ ওয়ানডে ম্যাচে মুখোমুখি হয়েছে বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে শ্রীলঙ্কা জয় পেয়েছে ৪৩ ম্যাচে, আর বাংলাদেশ জিতেছে ১২টিতে। ২টি ম্যাচ ফলাফলবিহীন ছিল।
রানের রেকর্ডে শ্রীলঙ্কা শীর্ষে
দু’দলের মুখোমুখি লড়াইয়ে সর্বোচ্চ দলীয় সংগ্রহ শ্রীলঙ্কার। ২০০৮ সালের এশিয়া কাপে লাহোরে ৯ উইকেটে ৩৫৭ রান করেছিল লঙ্কানরা। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ সংগ্রহ ৩২৪ রান।
অন্যদিকে সর্বনিম্ন রানের রেকর্ডে ওপরে বাংলাদেশ। ২০০২ সালে কলম্বোতে মাত্র ৭৬ রানে গুটিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ দল।
সবচেয়ে বড় জয় ও পরাজয়
২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পোস্ট অব স্পেনে ১৯৮ রানে জয় পায় শ্রীলঙ্কা, যা দু’দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়। বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় জয় পেয়েছে ১৬৩ রানে।
ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড
দু’দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রান মুশফিকুর রহিমের, ৩৯ ম্যাচে ১২০৭ রান। খুব কাছেই রয়েছেন কুমার সাঙ্গাকারা ৩১ ম্যাচে ১২০৬ রান।
এক ইনিংসে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ স্কোর শ্রীলঙ্কার তিলকারত্নে দিলশানের ১৬১ রান (২০১৫, মেলবোর্ন)। বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ মুশফিকুর রহিমের ১৪৪ রান (২০১৮ এশিয়া কাপ)।
সেঞ্চুরি ও ডাকের হিসাব
সর্বোচ্চ ৫টি সেঞ্চুরি করেছেন সাঙ্গাকারা। আর সবচেয়ে বেশি ৫ বার ডাক মেরেছেন বাংলাদেশের রুবেল হোসেন।
এক সিরিজে সর্বোচ্চ ২৪৮ রান করার রেকর্ড তিলকারত্নে দিলশানের। ২০১৪ সালে ৩ ওয়ানডেতে দুটি সেঞ্চুরিতে তিনি এই রানের পাহাড় গড়েছিলেন।
বোলিংয়ে মুরালিধরনের আধিপত্য
সবচেয়ে বেশি ৩১ উইকেট পেয়েছেন লঙ্কান কিংবদন্তি মুত্তিয়া মুরালিধরন। এক ইনিংসে সেরা বোলিং ছিল চামিন্দা ভাসের, ২০০৩ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের বিপক্ষে ২৫ রানে ৬ উইকেট, প্রথম ওভারে হ্যাটট্রিকসহ।
মাত্র চারজন বোলার ইনিংসে ৫ উইকেট পেয়েছেন। তারা হলেন- দুশমন্ত চামিরা, চামিন্দা ভাস, মুত্তিয়া মুরালিধরন ও বাংলাদেশের আব্দুর রাজ্জাক।
তবে সবচেয়ে ব্যয়বহুল বোলিং স্পেল ছিল আব্দুর রাজ্জাকের, ২০০৭ সালে ১০ ওভারে ৮৬ রান দিয়েছিলেন তিনি। এক সিরিজে সর্বোচ্চ ৯টি উইকেট পেয়েছেন চামিরা ও সনাৎ জয়াসুরিয়া।
ফিল্ডিং ও পার্টনারশিপে নজরকাড়া
মাহেলা জয়াবর্ধনে ২৬ ম্যাচে ১৮টি ক্যাচ নিয়ে আছেন তালিকার শীর্ষে। একই সঙ্গে উপল থারাঙ্গার সঙ্গে ২০১০ সালে করা ২১৫ রানের জুটি এখনো দুই দলের সর্বোচ্চ জুটির রেকর্ড।
অভিজ্ঞতায় এগিয়ে মুশফিক
দু’দলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলেছেন বাংলাদেশের মুশফিকুর রহিম। তিনি ২০০৭ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৩৯টি ম্যাচ।
সবশেষে বলতে হয় এই সিরিজ শুধু পরিসংখ্যান নয়, বরং মর্যাদা, মানসিক চাপ ও আত্মসম্মানের লড়াই। দু’দলের সম্পর্ক যতটাই জটিল, ঠিক ততটাই আকর্ষণীয় হতে যাচ্ছে আসন্ন ওয়ানডে সিরিজ। মাঠে এবার কারা বাজিমাত করেন, তা দেখার অপেক্ষায় বিশ্ব ক্রিকেট ভক্তরা।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, Bangladesherkhela.com এর দায়ভার নেবে না।