২০২০ সালে ইউরো চ্যাম্পিয়নশিপে ডেনমার্কের ক্রিস্টিয়ান এরিকসেনের কথা মনে আছে। ফিনল্যান্ডের বিপক্ষে মাঠেই অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন এই তারকা। তারপর প্রাথমিক শশ্রুষা করার পর হাসপাতালে দীর্ঘসময় চিকিৎসা নিয়ে অনেক দিন পর মাঠে ফিরে এসেছিলেন। ঠিক ভুটানের থিম্পুতে গতকাল এমন এক ঘটনা ঘটেছে। তবে ফুটবলার নয়, স্ট্রেচার বয়। জ্ঞান হারানোর উপক্রম এক স্ট্রেচার বয়কে প্রাথমিক চিকিৎসায় বাঁচিয়ে তুলে এখন সেখানে সবার কাছ থেকে প্রশংসা কুড়াচ্ছেন বাংলাদেশ দলের ৩১ বছর বয়সী ফিজিও আবু সুফিয়ান সরকার।
ঘটনার সূত্রপাত ফিফা প্রীতি ম্যাচে ভুটান বনাম বাংলাদেশের খেলার ৪৫ মিনিটের সময়। থিম্পুর চ্যাংলিমিথাং স্টেডিয়ামে ফরোয়ার্ড রাকিব হোসেন পায়ে চোট পেয়ে শুয়ে পড়েন। তাকে স্ট্রেচার দিয়ে তোলার জন্য ৪ জন স্ট্রেচারবয় মাঠে প্রবেশ করেন। কিন্তু এর মধ্যে একজন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। খিচুনি থেকে তার জ্ঞান হারানোর উপক্রম। সাধারণত এসব পরিস্থিতিতে রোগীর হার্ট কন্ডিশন খারাপ হয়ে যায় এবং কয়েক সেকেন্ডে মৃত্যুও হতে পারে।
সেই অবস্থায় আবু সুফিয়ান রাকিবকে ছেড়ে সেই স্ট্রেচারবয়ের চিকিৎসা করতে লাগলেন। তখন সিপিআর (কৃত্রিম শ্বাস এবং রক্ত সঞ্চালন প্রদানের জন্য জরুরী পদ্ধতি) ছাড়া উপায় থাকে না। ১০ থেকে ১৫ মিনিটের মতো সিপিআর দিয়ে সেই যাত্রায় কোনোমতে তার জ্ঞান ফেরে। এই সময়ে প্রায়ই শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছিলো। এরপর অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। আপাতত সেই স্ট্রেচারবয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে আছেন।
মাঠে ওই অবস্থা দেখে সবাই ভয় পেয়ে যান। তবে আবু সুফিয়ানের কৃতিত্বে প্রাণ বেঁচে যাওয়ায় সবাই তাকে বাহবা দিয়েছেন। বিদেশের মাঠে এমন মহানুভবতার কাজ করতে পেরে আবু সুফিয়ান নিজেও তৃপ্তি পেয়েছেন। থিম্পু থেকে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছেন, ‘রাকিব ভাই তো পায়ে চোট পেয়েছেন। যখন দেখলাম স্ট্রেচারবয়ের অবস্থা খারাপ। তার চিকিৎসার জন্য কেউ ছিল না তখন। আমি রাকিব ভাইকে রেখে সেখানে ছুটে যাই। গিয়ে দেখি জ্ঞান হারানোর উপক্রম। তখন দেরি না করে সিপিআর দেওয়া শুরু করি। মাথায় তখন একটাই চিন্তা কাজ করছিল, যেভাবেই হোক তার জ্ঞান সচল রাখতে হবে। অনেক চেষ্টায় জ্ঞান ফেরানোর পর অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে। আসলে ওই মুহূর্তে একজন মানুষের জীবন বাঁচানো বড় দায়িত্ব ছিল। প্রাথমিকভাবে শশ্রুষাই বড় বিষয়।’
সৈয়দপুরের ছেলে সুফিয়ান বাংলাদেশের গণস্বাস্থ্য থেকে ফিজিওর ওপর ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে বিভিন্ন ক্লাব ঘুরে এখন জাতীয় দলে কাজ করছেন। যদিও বসুন্ধরা কিংসই তার কাজের মূল ক্ষেত্র। বিদেশের মাঠে এমন ঘটনায় কারও জীবন বাঁচাতে পেরে সুফিয়ানের উপলব্ধি, ‘আসলে ওই সময় তাৎক্ষণিক চিকিৎসার জন্য সিপিআর ছাড়া উপায় ছিল না। তা নাহলে তার জীবন বাঁচানো কঠিন ছিল। যদিও পরবর্তীতে জানতে পারি তার খিচুনি আছে। সেসময় সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল। কী না কী হয়! সিপিআর যখন দেওয়া শুরু করি তখন ভয় পাইনি। নিজের ট্রেনিংয়ের অভিজ্ঞতা পুরোটাই কাজে লাগিয়েছি। তবে সেই ব্যক্তিটি এখন হাসপাতালে আছে। পুরোপুরি সুস্থ হলে তখন আরও ভালো লাগবে। আমার হাত দিয়ে কারও জীবন বেঁচেছে, এটাই বড় বিষয়। সৃষ্টিকর্তা হয়তো তাই চেয়েছিলেন।’
দেশের ক্রীড়াঙ্গনে জাতীয় দল ছাড়া ক্লাবগুলোর সবকটিতে সেভাবে ফিজিও নেই। এছাড়া দেশে অন্যসব রোগীর জন্য ফিজিওর প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করে সুফিয়ান বলেছেন, ‘খেলাধুলাতে ফিজিওর অবদান অনস্বীকার্য। একজন খেলোয়াড়ের জন্য ডাক্তারের পাশাপাশি ফিজিও অনেক কিছু করার সামর্থ্য রাখে। তাকে দ্রুত সুস্থ করে তোলা। রিহ্যাব থেকে শুরু করে সবকিছু। সব ক্লাবগুলোতে প্রয়োজন, সব খেলাতেও। এছাড়া দেশের বিভিন্ন রোগীর জন্য এখন ফিজিওর প্রয়োজন রয়েছে। যদিও আস্তে আস্তে এর প্রসার হচ্ছে। আমাদের ফিজিওরা ভালোও করছে। যদিও অনেকেই দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে।’
সুফিয়ান দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনে (এএফসি) অবদান রেখেছেন। তার ফিজিওর ওপর দুটি জার্নাল সেখানে জায়গা পেয়েছে। খেলাধুলা কিংবা সুস্থতায় ফিজিওর কোনও বিকল্প নেই, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তাই তো তপু বর্মণ, শেখ মোরসালিনদের মতো তারকারা তার হাত ধরে এখনও চোট কাটিয়ে ঠিকঠাক খেলে যাচ্ছেন।
মন্তব্য করুন
খবরের বিষয়বস্তুর সঙ্গে মিল আছে এবং আপত্তিজনক নয়- এমন মন্তব্যই প্রদর্শিত হবে। মন্তব্যগুলো পাঠকের নিজস্ব মতামত, Bangladesherkhela.com এর দায়ভার নেবে না।