শামীম চৌধুরী : ১৪ বছর আগের কথা বল ডেলিভারীর সময়ে পাকিস্তান টেল এন্ডার ওমর গুলকে রান আউট না করে রফিক করেছেন ভুল। ইনজামাম উল হকের সঙ্গে তার পার্টনারশিপ বাংলাদেশের হাতের মুঠো থেকে বের করে নিয়েছে ম্যাচ। অথচ, রফিকের ওই ভুলকে ক্রিকেটীয় দৃস্টিকোন থেকে কেউ কেউ দেখেছে উদারতা।
আবার মুলতান টেস্টে ১ উইকেটে হারের কারন হিসেবেও রফিকের সেই উদারতাকে ‘নির্বুদ্ধিতা’ বলে মূল্যায়ন কারো কারো। বাংলাদেশের ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় ওই ট্র্যাজেডী থেকে শিখতে শিখতে এই প্রজন্মের ক্রিকেটাররা অনেক বেশি আক্রমনাত্মক, তা দেখছে এখন বিশ্ব ! স্লেজিংকে খেলার মাঠে শিল্পের পর্যায়ে এনেছে যারা, সেই অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত মাঠে বাংলাদেশ দলের পরিবর্তিত মেজাজ দেখে হতভম্ব। এক সময়ে বাংলাদেশ দলের টেস্ট মর্যাদা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন যারা, তাদের উত্তর দিতে পারেনিÑক্রিকেট সামর্থে কাছাকাছি না থাকায়। এখন তাদেরকেই ঘোষনা দিয়ে হারানোর হুংকার দিতে পারছে, এবং মাঠে সেই হুংকারের প্রতিফলন দেখছে বিশ্ব। প্রতিপক্ষকে মনস্ত¡াত্বিক লড়াইয়ে হারিয়ে দিতে এক সময়ে বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করতো অস্ট্রেলিয়া দল, তাদের মিডিয়াও উসকে দিত পরিবেশ। এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দল প্রতিপক্ষের উপর মনস্ত¡াত্বিক চাপ তৈরি করে। ঢাকায় পা রাখা মাত্রই অস্ট্রেলিয়ার উপর কৌশলগত চাপ সৃস্টি করেছে বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়ার র্যাঙ্কিং,১৪০ বছরের টেস্ট ঐতিহ্যÑকোন কিছু বিবেচনায় না এনে বাংলাদেশ কোচ হাতুরুসিংহের দাবি,এই সিরিজে ফেভারিট বাংলাদেশ। সাকিবের বিশ্বাস,২-০তে অস্ট্রেলিয়াকে হারানো সম্ভব, ঢাকা টেস্ট পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুরও সাকিবের সেই ধারনার সাথে পোষন করেছেন একমত। ম্যাচপূর্ব সংবাদ সম্মেলনে মুশফিকুরের ওই ধারনা শুনে অজি অধিনায়কের মাথায় হাতÑ‘ বাংলাদেশ তো মাত্র ১০০ টেস্ট খেলেছে, জিতেছে মাত্র ৯টিতে। এই দলটি এতোটা আত্মবিশ্বাস পায় কিভাবে ?’ সেই প্রশ্নের জবাব পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। নিক্তিতে সামর্থটা এখন উনিশ-বিশ, হোম কন্ডিশনের ফেভার নিতে জানে বাংলাদেশ, কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও এখন সর্বশক্তি দিয়ে লড়তে পারে বাংলাদেশ দল। টেস্টে এই বিশ্বাসের বয়সটা খুব বেশি নয়,১০ মাসের মতো।
গত বছর ইংল্যান্ডকে ঢাকা টেস্টে হারিয়ে দেয়ার ভিডিও ক্লিপিংসটা দেখুনÑতৃতীয় দিনে টী’ ব্রেকের সময়ে ইংল্যান্ডের স্কোর উইকেটহীন ১০০, সেখান থেকে পরের ঘন্টায় ৩৭ রানে ৫ উইকেট, পরের ৫১ বলে শেষ ৫ উইকেট শিকারে ইংল্যান্ডের অহমে ধাক্কা ! ১০৮ রানে অবিশ্বাস্য জয়। ওই ম্যাচের ছবিটাই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে দারুন কিছু’র প্রেরনা দিয়েছে। ম্যাচের তৃতীয় দিন শেষে অস্ট্রেলিয়ার স্কোর যখন ১০৯/২, জয় থেকে ১৫৬ রান দূরে সফরকারী দল, তখন বাংলাদেশ মিডিয়া দুর্ভাবনায় তাড়িত হলেও আশার হাল ছাড়েননি তামীম। নিজের ৫০তম ম্যাচে ২ ইনিংসে ফিফটি,বন্ধু সাকিবের অল রাউন্ড পারফরমেন্স বৃথা যেতে পারে নাÑইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই ছবিটাই ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর দল, মিডিয়ার মাধ্যমে দেশবাসীকে আশ্বস্ত করেছিলেন তা। কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে, স্মিথ-ওয়ার্নারের ১৩০ রানের পার্টনারশিপ ভেঙ্গে দিয়ে ম্যাচে ফিরেছে বাংলাদেশ। লো বাউন্সি ডেলিভারীতে ওয়ার্নারকে এলবিডাব্লুতে ফিরিয়ে দিয়ে সেই যে শুরু, দিনের প্রথম সেশনে ৫ অজি ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দিয়ে জয়ের আবহ পেয়েছে বাংলাদেশ। ম্যাচের সেরা কুশীলব সাকিবের ২০ ওভারের এক স্পেলে (২০-৫-৫৭-৪) অজি দম্ভে আঘাত, ২০ রানের জয়ে টেস্টের সাবেক নাম্বার ওয়ানদের বিপক্ষে বীরত্বপূর্ন জয়।
প্রথম জয়ে বাংলাদেশকে অপেক্ষা করতে হয়েছে ৩৫তম ম্যাচ পর্যন্ত, প্রথম ১০০ ম্যাচে জয় মাত্র ৯টি। টেস্ট অধ্যায়ে নুতন সেঞ্চুরি শুরু হয়েছে সেখানে জয় দিয়ে ! অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পুরো সাড়ে তিন দিন কর্তৃত্ব করে। মিরপুরে উপর্যুপরি ২ জয় দেখেছে বাংলাদেশ, দেশের বাইরে শততম টেস্ট জয় দিয়ে রাঙিয়ে আর একটি উপর্যুপরি জয়। সর্বশেষ ৬ ম্যাচে ৩ জয়Ñইংল্যান্ড,শ্রীলংকার পর অস্ট্রেলিয়া! চোখকেও যে বিশ্বাস হচ্ছে না। বাংলাদেশ দলের বিপক্ষে খেলেছেন ওয়ানডে, এই প্রথম টেস্ট খেললেন স্মিথ। তবে ক্রিকেট মাঠে বাংলাদেশের জয়ের নেপথ্যে যে আক্রমনাত্মক মেজাজ। অজি অধিনায়ক নিজেই এমন মেজাজ দেখে বিস্মিতÑ‘এখানে তাদেরকে যেভাবে দেখলাম,তাতে বলতে পারি, তারা ভয়ংকর দল। এই কন্ডিশনে তারা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। খুব বেশি দিন আগে নয়,তারা ইংল্যান্ডকে হারিয়েছে,এবার আমরা হারলাম। দলটিতে আছে বেশ ক’জন আক্রমনাত্মক ক্রিকেটার। প্রথম ইনিংসে সাকিবের ব্যাটিং সত্যিই ছিল আক্রমনাত্মক।’ স্মিথের এমন মন্তব্য শুনে মুচকি হাসি দিয়েছেন সাকিব। বলেছেনÑ‘ আগ্রাসন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই, সবার যেন এই সাহস থাকে। দলের জন্য ইতিবাচক মনোভাব থাকলে তা দলের জন্য ভালো । ঘরের মাটিতে আমরা বিশ্বাস করি আমরা যে কাউকে হারাতে পারি, সেটা করেও দেখিয়েছি। ইংল্যান্ডের সঙ্গে আমাদের জেতার বিশ্বাস শুরু হয়েছে আজকে। আমরা যে ক্যামব্যাক করতে পারি, সেই বিশ্বাস এসেছে তখন। আগে এটা করতাম না, আগে হলে ছেড়ে দিতাম। এটা একটা বড় অর্জন।
ওরাও বুঝেছে বাংলাদেশও কতটা আগ্রাসী হতে পারে। শুধু ব্যাট-বল না শারীরিক ভাষাতেও ওরা সেটা টের পেয়েছে। শ্রীলঙ্কায় গিয়ে কিন্তু ভারত ছাড়া খুব বেশি কেউ ভালো করেনি। বাইরে জিততে পারি, সেটাও আমাদের জন্য বড় ব্যাপার ছিল। ’ আত্মবিশ্বাসের পারদ এতোটাই উঁচুতে যে, এখন বাংলাদেশ দল জোর গলায় যে কোন দলকে হারানোর হুংকার দিতে পারে, ধারাবাহিক পারফরমেন্সে ক্রিকেট বিশ্বকে তা জানিয়ে দিয়েছেন মুশফিকুর রহিমÑ‘ আমরা বলেছি অস্ট্রেলিয়াকে ২-০তে হারানো সম্ভব। এটা শুধু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে নয়, যে কোনো দলের বিপক্ষেই ঘরোয়া ক্রিকেটে এটা বলার চেষ্টা করবো। কারণ হোম কন্ডিশনের শক্তিটা আমরা জানি। যতো বড় দলই হোক না কেনো, এই কন্ডিশনে আমরা যে কোনো পরিস্থিতিতে জিততে পারি। কেউ হয়তো বলতে পারে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে আমরা কোনোমতে জিতে গেছি। কিন্তু এখন আর সেটা বলতে পারবে না।’ এক সময়ে জয় উদযাপনে ল্যাপ অব অনারে অন্য আবহ তৈরি করতো বাংলাদেশ দল। এখন ল্যাপ অব অনারের মতো পরিস্থিতি আর নেই, জয়ে অভ্যস্ত বাংলাদেশ দল সাদামাটা উদযাপনেই যে থাকছে সীমাবদ্ধ।